সময়ের ব্যবচ্ছেদ : রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও রাষ্ট্র মেরামত

আমাদের রাষ্ট্র যে এক নতুন সময়ে প্রবেশ করেছে এটা কারোর কাছেই অজানা নয়। নির্বাচনে অবাধ ভোট কারচুপি যে খুব সাম্প্রতিক ধারণা তা না। কিন্তু সর্বশেষ নির্বাচনের এরকম প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধহীন কারচুপি স্বাধীনতার পর এই প্রথম।

বই: সময়ের ব্যবচ্ছেদ, লেখক: সারওয়ার তুষার ও সহুল আহমেদ   

বিগত ২০ বছরের রাজনীতির অভিজ্ঞতা অধিকাংশ জনগনের রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ও সরকার সম্পর্কিত অনুসন্ধান ও আগ্রহ লোপ করেছে। এর কারণ হলো, এতদিন আমাদের আলাপে ছিল সরকার, রাষ্ট্রের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, পুলিশ, আইন-আদালত, পার্লামেন্ট ইত্যাদি। এসব নিয়ে অনেক বিচ্ছিন্ন আলাপ-আলোচনা আমরা করেছি। মনে করেছি, পুলিশ ঠিক হলে বাকি সব ঠিক, নাহয় বলেছি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এসব যে রাষ্ট্রের খুবই ক্ষুদ্র উপাদান সেটা আমরা মাথায় রাখি নাই। এজন্য রাষ্ট্র নামক সুবিশাল একটা যন্ত্রের যে একটা অস্তিত্ব আছে সেটা তেমন আলোচনায় আসে নি। আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, রাষ্ট্র ঠিকই আছে, শুধু এটা ওটা পরিবর্তন করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। একারণে 'রাষ্ট্র' নামক আস্ত একটা বৃহদাকার যন্ত্রকে আমরা আলোচনার বাইরে রেখে দিয়েছি। আর বলেছি, "রাষ্টের আইন-কানুন মানা হয় না বলে এই দুর্দশা"। বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং এইবারের নির্বাচন খুব পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমস্যা আছে। পুরো রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার ছাড়া এর কোনো সমাধান নেই। রাষ্ট্র মেরামত করা এখন আমাদের সময়ের প্রয়োজন

বাধা-বিপত্তির মধ্যেও বিভিন্ন সমালোচক, রাজনীতি চর্চাকারী ও একটিভিস্ট অনেকেই নিজেদের চিন্তাভাবনা, মত প্রকাশ করছেন এবং বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। বর্তমান সময়ে সরকারের সমালোচনা তো দূরের কথা জনগণের কোনো ব্যক্তিস্বাধীনতাই নেই। না আছে মুক্ত চিন্তা ও মত প্রকাশের সুযোগ। সংবাদ ও গণযোগাযোগ মাধ্যমের অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো কিছুতে হস্তক্ষেপ ও অনুসন্ধান করার কোনো সুযোগ নেই।

যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণই রাষ্টের মালিক। যেখানে রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হয় জনগণকেই। সরকারের যেকোনো কর্মকাণ্ড, উদ্যোগ ও ব্যর্থতা নিয়ে গঠণমূলক আলোচনা-সমালোচনা, বিভিন্ন অভিমত প্রকাশ এবং কোনো বিষয়ে রাষ্ট্রের কাছে জবাবদিহিতা চাওয়ার অধিকার জনগণ রাখে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই। 'গণতান্ত্রিক কাঠামো' নামক কাগজে মোড়ানো এই রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে স্বৈরতন্ত্রের কালো ছাপ।

গতসালে পড়া 'সময়ের ব্যবচ্ছেদ' বইটিতে জর্জ অরওয়েলের '১৯৮৪' উপন্যাসের "Big brother is watching you" কথাটিকে আমাদের য়েছেন সারওয়ার তুষার ভাই। 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন' জনগণের নিরাপত্তার জন্য নয় বরং সকল ধরণের ভিন্নমত ও সমালোচনা থেকে রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রণীত। যা নাগরিকদের মত প্রকাশ, চিন্তা করার স্বাধীনতা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে দণ্ডনীয় করে তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে কঠোর নজরদারি। এই আইনে পুলিশকে ওয়ারেন্ট ছাড়া শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে বাড়ি ও কর্মস্থলে ঢুকে তল্লাশি, ইলেকট্রনিক সরঞ্জামাদি জব্দ এবং গ্রেফতার করার একচেটিয়া অধিকার দেওয়া হয়েছে। অনেক ধরনের শব্দ অস্পষ্ট রাখা হয়েছে যাতে শব্দগুলোকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাষ্ট্রের পক্ষে ইচ্ছামতো ব্যাখ্যা করা যায়। বিশ্ব অর্থনীতির বাজারে টিকে থাকতে রাষ্ট্রের প্রধান কর্তৃব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা জনিত সমস্যা, নাগরিকের নিরাপত্তাহীনতা ও প্রতিনিয়ত সংকট উৎপাদন করা। 

বেশ কিছু বছর ধরেই একটা জিনিস খুব অহরহ ঘটছে। একটু লক্ষ্য করলেই সেটা বোঝা যায় যে, বিভিন্নরকম ছোট-খাটো বিষয়কে কেন্দ্র করে গ্রেফতার করে অবৈধভাবে গ্রেফতারকে স্বাভাবিক বানিয়ে নিচ্ছে সরকার। একটু ভিন্ন ধরনের 'চুলের কাটিং' এর জন্যেও গ্রেফতার করে চুল ছেটে দেওয়া হয়েছে এমন নজির ও আছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা এবং ব্যার্থতা এড়াতে অনেক ধরনের ফালতু ও অপ্রয়োজনীয় ঘটনাগুলোকে জনগণের সামনে ফোকাস করা হচ্ছে, যাতে মানুষজন সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব নিয়ে মেতে থাকে। স্বৈরশাসক রাষ্ট্রের কাছে এরকম প্রোপাগাণ্ডা বিশাল অস্ত্র। 

একটা প্রোপাগাণ্ডা অনেক আগেই দাঁড় হয়েছে। সেটা হলো, রাষ্ট্রপক্ষ সবকিছুকে লুকিয়ে সত্যকে বলছে গুজব আর সেটাকে বৈধ করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বানোয়াট কথাবার্তা দিয়ে অন্যসব গুজব ছড়াচ্ছে। আর সমালোচনা এড়াতে আর এই সুযোগে 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন' এর সাহায্যে সাদা পোষাকে লেখক, সম্পাদক, মানবাধিকার কর্মী, কার্টুনিস্ট, শিক্ষক সাংবাদিকদের মতো সত্য প্রকাশকারী এবং প্রশ্নকারীদের তথাকথিত গুজব রটানোর দায়ে 'রাষ্ট্রবিরোধী', 'রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি নষ্টকারী' 'চেতনাবিরোধী', 'গুজব রটনাকারী' তকমা দিয়ে আটক করছে। অদ্ভুত এই আইন দিয়ে রাষ্ট্র যেমন নিজেদের নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে, তেমনি স্বৈরতন্ত্রকে দিয়েছে বৈধতা। করোনা মহামারীতে বিভিন্ন প্রোপাগাণ্ডাকে বেশ ভালভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। এই আইনটি এমনকি এ দেশেরই সংবিধান বিরোধী।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে দমন-পীড়ন-গ্রেফতার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। সরকারের সমালোচনা, ভিন্নমত পোষণ করলেই এই আইনের জালে ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে সবাইকে। সরকার তার অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বৈরাচারী আচরণ বলবৎ রাখতে এই নিপীড়ক আইন খুব ভালোভাবে ব্যবহার করছে।

সরকারের সকল স্বৈরতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনগণের সক্রিয় হওয়ার পথকে 'ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট' এর মাধ্যমে 'আইনি' পদ্ধতিতে রুদ্ধ করছে সরকার। গত বছরের মে মাসে এই গণবিরোধী আইনে আটক করা হয়েছিল রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ভুঁইয়া, কার্টুনিস্ট কিশোর, লেখক মোস্তাক সহ আরো অনেককে। ৫৩ দিন নিখোঁজ থাকার পরে সাংবাদিক কাজলের বিরুদ্ধেও একই আইনে মামলা করা হয়েছে। প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল, শহিদুল আলমের বিরুদ্ধেও একই আইনে মামলা করা হয়েছে রাষ্ট্রের 'ভাবমূর্তি' ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে। 

বাংলাদেশের নাগরিক মাত্রই আজকে এই আইনি নিপীড়নের এক একজন সম্ভাব্য ভিক্টিম। সুতরাং, এই আইনের বিরুদ্ধে কথা বলা, সক্রিয় হওয়া সমস্ত পক্ষের জন্য অত্যন্ত জরুরি কর্তব্য। আমাদের সবাইকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে সরব হতে হবে এবং এই গণবিরোধী আইন প্রণয়নের যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা তাকে বদলাতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটককৃতদের আশু মুক্তি, গণবিরোধী আইন বাতিল ও এহেন আইন প্রণয়নের সাংবিধানিক একচেটিয়া ক্ষমতার বিরুদ্ধে আমাদের একসাথে অবস্থান করতে হবে। সময় এসে গেছে সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই গণবিরোধী ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলে গণক্ষমতাতান্ত্রিক বাংলাদেশ তৈরি করার।

"চিন্তা পুলিশিং নিপাত যাক,
'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন' বাতিল কর"


পর্যালোচনা : ০২
বই: সময়ের ব্যবচ্ছেদ
লেখক: সারওয়ার তুষার ও সহুল আহমেদ
পর্যালোচক: সামি আব্দুল্লাহ্ মে ২০, ২০২০

Comments

Popular Posts